• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাতের ট্রেনে ‘মৃত্যুঝুঁকি’


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৮, ২০১৭, ০৩:৫৭ পিএম
রাতের ট্রেনে ‘মৃত্যুঝুঁকি’

শফিকুল ইসলাম। দীর্ঘ ১০ বছর মালয়েশিয়ায় প্রবাস জীবন কাটিয়ে স্বজনদের কাছে ফিরছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মাজুআইল গ্রামে। সোমবার (১৬ জানুয়ারি) রাতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। গ্রামে ফেরার আকুলতায় রাতের ট্রেনে চেপেই রওনা হন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবনের শেষ ট্রেনেই চেপে বসেছেন তিনি।

শফিকুল (৩৫) বিয়ে করেছেন মালয়েশিয়ায়। সেখানেই কাটছিল তার সুখের সংসার। তবু নাড়ির টানে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্বৃত্তদের লোলুপ দৃষ্টি কেড়ে নেয় তার জীবন। প্রবাসী দেখে তার ওপর হামলা পড়ে ছিনতাইকারীরা। সর্বস্ব লুটে নিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেয় খুনিরা। 

মুহূর্তেই নিভে যায় শফিকুলের আবেগঘন স্বপ্নগুলো। যে স্বপ্ন আর আবেগ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন, তা রাতের ট্রেনে ধ্বংসলীলায় পড়ে থাকে। মৃতদেহের সঙ্গে পড়ে থাকে স্বপ্ন, স্তব্ধ থাকে আবেগ। গতকাল মঙ্গলবার গাজীপুরে রেললাইনের পাশ থেকে মালয়েশিয়া প্রবাসী শফিকুলের লাশ উদ্ধার কররে পুলিশ। 

এ বিষয়ে টঙ্গী রেলওয়ে থানা পুলিশের এএসআই দেলোয়ার হোসেন জানান, মালপত্র ছিনিয়ে নিয়ে শফিকুল ইসলামকে ট্রেন থেকে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। মৃতদেহের একটু দূরে থেকেই শফিকুলের ব্যাগটি পাওয়া যায়। সেই ব্যাগে শফিকুল ও তার মালয়েশীয় স্ত্রী সিতি হাজার বিনতির পাসপোর্ট ছিল।

শুধু শফিকুল নয়, রাতের ট্রেনে এর আগেও অসংখ্য যাত্রীর প্রাণ গেছে সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের হাতে। সামান্য কিছু টাকা আর একটি মোবাইল ফোনের জন্য যাত্রীদের হত্যা করছে দুর্বৃত্তরা। এসব হত্যাকান্ড চলছে বছরের পর বছর। যেন দেখার কেউ নেই। 

ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চল এবং চট্টগ্রামে চলাচলকারী রাতের বিভিন্ন ট্রেনেই ঘটছে বেশি। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামমুখী রেললাইনের কিছু স্পটে প্রায় দেড় শতাধিক মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে আখাউড়া, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে নরসিংদী পর্যন্ত। পুলিশ লাশগুলোর বেশির ভাগ অজ্ঞাতপরিচয় কিংবা আত্মহত্যা হিসেবে রেকর্ড করে থাকে। আর তাই হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো আড়ালেই থেকে যায়। 

অনেক দিন মর্গে থাকা লাশ মাটিচাপা পড়ে। হিন্দু কি মুসলিম কোনো ব্যাপার-ই না, সব মাটিচাপা। আর অজ্ঞাতপরিচয় সেই ব্যক্তির জামাকাপড় রেলওয়ে ডোম ঘরের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। তবে বছর দুয়েকের মধ্যে স্বজনদের সন্ধান না পাওয়া গেলে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবেই থেকে যায়।

লুটেরাদের কৌশল : ট্রেনের দুই বগির মাঝখানে করিডরের মতো থাকে, দুই পাশে দরজা, সঙ্গে বাথরুম। রাতের ট্রেনে এসব জায়গায় সুবিধামতো কোনো যাত্রী পেলেই হামলে পড়ে ছিনতাইকারী চক্র। হামলার সময় শিকারকে পেছন থেকে আক্রমণ করে দুজন। এরপর গামছাকে চিকন করে পেঁচিয়ে দুই মাথা দুজন ধরে যাত্রীর গলায় দেয় হ্যাঁচকা টান। ১৫ সেকেন্ডেই কুপোকাত সেই যাত্রী। এরপর সেই যাত্রীর সর্বস্ব লুটে নিয়ে নিথর দেহ ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। 

রাতের ট্রেনে সবাই ঘুমায়। তা ছাড়া চলন্ত ট্রেনের আওয়াজ থাকে। কেউ কিছুই টের পাবে না, এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে পেশাদার চক্রটি। পুরো কাজটা করতে সময় লাগে সর্বোচ্চ দেড় মিনিট। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এভাবেই প্রাণ হারাচ্ছেন রাতের ট্রেনের যাত্রীরা। তবু কোনো প্রতিকার খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। আবার দুয়েকটা ঘটনায় হাতেনাতে ধরাও পড়ে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু পর্যাপ্ত সাক্ষী আর আলামতের অভাবে সহজেই জামিন পেয়ে যায় অপরাধীরা।

গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাটগামী সেভেন আপ ট্রেনের ছাদ থেকে ফেলে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ যাবৎকালে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিতাস কমিউটারে যাত্রীবেশী ডাকাতের তান্ডবে। ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে চার যাত্রীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

গত বছরের ২৬ অক্টোবর গুড়া সেনানিবাসের ওয়ান সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের সদস্য আবদুুর রহমানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ট্রেন থেকে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি ব্যাংক কর্মচারী শাহাদাত হোসেনকে খুন করে আখাউড়ার গঙ্গাসাগর এলাকায় ট্রেন থেকে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। একই বছর একটি আন্তঃনগর ট্রেনের গার্ডকে ট্রেনের বাথরুমে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। 

একই বছর রেললাইনের পার্শ্ববর্তী স্থান থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়। একের পর এক খুনের ঘটনায় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় ট্রেনে ডাকাতি ও হত্যাকান্ডের প্রবণতা বাড়ছে। চোরাকারবারিরা ট্রেনচালকদের সঙ্গে যোগসাজশে আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী বিভিন্ন স্থানে ট্রেন থামিয়ে মাদক পাচার করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এটি ট্রেন হত্যাকান্ডের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

এদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ ডাকাত-ছিনতাইকারীদের নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে। এ পথে প্রতিনিয়তই মালপত্র লুট করে যাত্রীদের হত্যা করা হচ্ছে। গত ৩ মাসে এ পথে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে ৩৯ জনকে হত্যা করা হয়। 

এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বর রাতে এ রেলপথে ত্রিশালের বালিপাড়া ও ধলা এলাকায় ট্রেন থেকে ফেলে দুজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ রেলপথে প্রতি মাসে অসংখ্য মানুষ নিহত হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো আসামিকেই আটক বা শনাক্ত করতে পারেনি।

ট্রেনে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক ঘটছে হত্যাকান্ড। অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে ট্রেন যাত্রীদের। এসব নির্মম হত্যাকান্ডে ট্রেনের যাত্রীরা অসহায় ও আতঙ্কিত। একেকটা ঘটনা ঘটার পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আশ্বস্ত করেন যাত্রী নিরাপত্তায় ট্রেনে পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। 

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কর্তৃপক্ষের ওই ঘোষণা শুধু বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয় না। ঘটনার পর দায়িত্বরত পুলিশ কিংবা রেল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাময়িক বরখাস্ত করেই দায় সারছে কর্তৃপক্ষ। 

এ যাবৎ ট্রেনের যাত্রীর হত্যার ঘটনায় তদন্ত করছে রেলওয়ে পুলিশ। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দুর্বৃত্তদের আটক কিংবা শাস্তি হয়েছে এমনটি শোনা যায়নি। ফলে ট্রেনে ডাকাতি কিংবা যাত্রী হত্যার দায় কিছুতেই কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!